ডেস্ক রিপোর্টঃ
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে বালু-মাটি রপ্তানির সুযোগ রাখা হলেও প্রক্রিয়া নির্ধারিত ছিল না। বালু ও মাটি রপ্তানির প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে নতুন ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২৪’ এর খসড়া করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়া অনুযায়ী, নানান প্রক্রিয়া অনুসরণের পর বালু বা মাটি রপ্তানির চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
খসড়া বিধিমালাটি চূড়ান্ত করতে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে বালু ও মাটি রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
২০১০ সালের বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে রপ্তানির বিষয়টি আছে। কিন্তু কী পদ্ধতিতে রপ্তানি হবে সেটি নির্ধারিত ছিল না। বলা ছিল, বিধিমালা দিয়ে তা নির্ধারিত হবে। কিন্তু ২০১১ সালে আইনের অধীনে করা বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালাতেও তা ছিল না। এখন নতুন বিধিমালায় সেটি অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সায়রাত) দেলোয়ার হোসেন মাতুব্বর জাগো নিউজকে বলেন, নতুন বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালার খসড়া করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে সেটি চূড়ান্ত হবে। এতে নতুন কিছু বিষয় থাকছে। এটি বেশ বিস্তারিত বিধিমালা। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত নয়।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ দেশের প্রধান নদীগুলোতে নাব্য সংকট রয়েছে। বালুর চরে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ। প্রতি বছর খননের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলো সচল রাখতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে নদীগুলোর অতিরিক্ত বালু রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে আগ্রহও দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, বিগত সময়ে সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে বালু আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু পদক্ষেপ ছিল। পরে আর সেই উদ্যোগগুলো আলোর মুখ দেখেনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন দেশে আমাদের বালুর চাহিদা আছে। সব দিক বিবেচনা করে আমাদের জন্য সুবিধাজনক হলে আমরা বালু বা মাটি রপ্তানি করতে পারি।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে বিধিমালার খসড়াটা এলে প্রয়োজনীয় মতামত দেবো। রপ্তানির প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও যুক্ত থাকবে।
খসড়া বিধিমালায় বালু বা মাটি রপ্তানির বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকারের সময় সময় প্রণীত রপ্তানি নীতি ও আদেশে বালু ও মাটি রপ্তানির বিধান থাকা সাপেক্ষে বাংলাদেশ থেকে বালু বা মাটি বিদেশে রপ্তানির কেস টু কেস প্রস্তাবের বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় এই বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এতে বলা হয়, নদীর কোনো ডুবোচর বা চর যেখানে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ অনুযায়ী উত্তোলনযোগ্য বালু বা মাটি আছে, ওই স্থান থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করলে পরিবেশ বা প্রতিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না বা নদী ভাঙনের শিকার হবে না বা নদীর গতিপথের পরিবর্তন হবে না বা সরকারি কোনো স্থাপনার ক্ষতি হবে না, এ বিষয়ে বন, পরিবেশ ও জলবালু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার ইতিবাচক মতামত থাকলে, কেবল সেই স্থান থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করে বিদেশে রপ্তানির জন্য আবেদন করতে পারবে।
বালু বা মাটি রপ্তানি করতে আগ্রহী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেশের আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে নির্ধারিত ফরমে দাখিল করা আবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে ভূমি মন্ত্রণালয় কেবল সে ক্ষেত্রেই পদক্ষেপ নেবে বলে বিধিমালায় বলা হয়েছে।
আবেদন পাওয়ার পর ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগ তা প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে আবেদনটি যথাযথ হলে পরীক্ষা করে সুপারিশ ও মতামত দিতে তা সুপারিশ প্রেরণ কমিটির কাছে উপস্থাপন করবে। সুপারিশ প্রেরণ কমিটির সভাপতি হবেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব/যুগ্মসচিব (মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ)।
সুপারিশ প্রেরণ কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর ভূমি সচিবের সভাপতিত্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পর্যালোচনা করে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বালু বা মাটি রপ্তানির প্রস্তাব কেস টু কেস পর্যালোচনা করে বাতিল করতে পারবে, কিংবা প্রয়োজনীয় মনে করলে রপ্তানি প্রস্তাব বিবেচনার জন্য জাতীয় কমিটিতে উপস্থাপনের সুপারিশ করতে পারবে।
বিধিমালায় আরও বলা হয়, উপস্থাপিত সুপারিশ ও প্রস্তাবিত বালু বা মাটির উৎস, রপ্তানির অনুকূল বা প্রতিকূল প্রভাব, প্রস্তাবিত বালু বা মাটির পরিমাণ, পরিমাপের একক ও একক ভিত্তিক মূল্য এবং রপ্তানি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্যক পর্যালোচনার পর প্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করে জাতীয় কমিটি বালু বা মাটি রপ্তানির প্রস্তাব সরকারপ্রধানের অনুমোদনের জন্য সুপারিশ বা নামঞ্জুর করতে পারবে কিংবা কমিটির বিবেচনায় যুক্তিযুক্ত অন্য কোনো নির্দেশনা দিতে পারবে।
বালু বা মাটি রপ্তানির আবেদন বা প্রস্তাব প্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করে জাতীয় কমিটি অনুমোদনের সুপারিশ করার পর তা অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ সরকার প্রধানের কাছে পাঠাতে হবে। প্রাপ্ত আবেদন বা প্রস্তাব অনুমোদন বা বাতিল বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত ভূমি মন্ত্রণালয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানাবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বালু আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ওই বছরের ২৩ নভেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে বালু রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পরের বছরের ২৯ মে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ নাসিমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তখনকার ভূমিমন্ত্রী মো. রেজাউল করিম হীরা জানিয়েছিলেন, মালদ্বীপের বিশেষজ্ঞ দল এসে পর্যবেক্ষণ করে কোন মানের ও কী পরিমাণ বালু আমদানি করবে তা ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানাবে। মালদ্বীপের চাহিদা জানানোর পর আমরা আমাদের মতামত জানাবো। এরপরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রপ্তানির কাজ সম্পন্ন করা হবে।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৭ মার্চ জাতীয় বালু মহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যমুনার বালু মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করা হবে। এ দুই দেশে রপ্তানির জন্য উত্তোলিত বালু প্রতি ঘনফুটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক টাকা। তখনকার ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের সভাপতিত্বে ওই সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রী, ভূমি প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। এ উদ্যোগগুলো পরে আরও বাস্তবায়িত হয়নি।